[বি:দ্র: এই গবেষণাটি তথ্যনির্ভর, তবে তার বুননে আছে সময়ের ধুলোমাখা আয়না—যেখানে ইতিহাস শুধু অতীত নয়, বর্তমানের প্রতিচ্ছবিও। এখানে উল্লিখিত ঘটনাগুলো নথিভুক্ত, চরিত্রগুলো বাস্তব, কিন্তু তাদের সংলাপ যেন সময়ের গোপন ফিসফাস।
বিশ্বাস
করলে—তুমি দেখতে পাবে, ফ্যাসিবাদ কখনোই পুরোপুরি হারায় না, শুধু পোশাক বদলায়। আর অবিশ্বাস
করলে—হয়তো ঠিক তখনই, কোনো পরিচিত মুখে তুমি সেই পুরোনো ছায়াটা খুঁজে পাবে।
বস্তুত,
ইতিহাসের পাঠ যদি সতর্কতা না জাগায়, তবে দোষ গবেষকের নয়—সময়ের, যে বারবার একই গল্প
বলে, একটু ভিন্ন সুরে।]
ফ্যাসিবাদ: অস্থির শতাব্দীর এক কালো ছায়া
ভূমিকা: ফ্যাসিবাদ কী এবং কেন?
ফ্যাসিবাদ: এক অস্থির শতাব্দীর প্রতিচ্ছবি
ফ্যাসিবাদ, সে এক অদ্ভুত শব্দ। যেন কুয়াশার চাদরে মোড়া এক অচেনা পথ। তার জন্ম হয়েছিল ইউরোপের অশান্ত এক সময়ে, যখন মানুষ খুঁজছিল নতুন কোনো মন্ত্র। এই মতবাদ কেবল একটি রাজনৈতিক ধারণা নয়, এটি এক অস্থির সময়ের প্রতিচ্ছবি, যেখানে পুরোনো বিশ্বাসগুলো ভেঙে যাচ্ছিল আর নতুন এক অন্ধকারের জন্ম নিচ্ছিল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট আর সামাজিক ভাঙন দেখা দিচ্ছিল, তখন ফ্যাসিবাদ এক নতুন আশার আলো হয়ে এসেছিল অনেকের কাছে। কিন্তু সেই আলো আসলে ছিল এক মরীচিকা, যা শেষ পর্যন্ত মানবতাকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এই অস্থিরতা কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ছিল না; এটি ছিল মানুষের মনের গভীরে প্রোথিত এক শূন্যতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, পুরোনো সাম্রাজ্যগুলোর পতন, আর নতুন করে গড়ে ওঠা জাতিরাষ্ট্রগুলোর মধ্যেকার সংঘাত—এসবই মানুষকে এক গভীর হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। যখন প্রচলিত ব্যবস্থাগুলো মানুষের আশা পূরণ করতে পারছিল না, তখন তারা এক নতুন, শক্তিশালী সমাধানের খোঁজে ছিল। ফ্যাসিবাদ সেই শূন্যস্থান পূরণ করার এক ভয়ঙ্কর উপায় হয়ে ওঠে, নিজেকে "নতুন সমাধান" হিসেবে উপস্থাপন করে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক মতবাদ নয়, বরং সমাজের গভীর ক্ষত থেকে জন্ম নেওয়া এক মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাধি। তাই ফ্যাসিবাদকে কেবল একটি মতাদর্শ হিসেবে না দেখে, তাকে "অস্থির শতাব্দীর প্রতিচ্ছবি" হিসেবে উপস্থাপন করা এক গভীরতর উপলব্ধির জন্ম দেয়, যা এর সামাজিক শিকড়কে তুলে ধরে।
সংজ্ঞা ও পরিচিতি: এক ঝলকে
ফ্যাসিবাদ হলো সুদূর-ডানপন্থী, কর্তৃত্ববাদী এবং অতি-জাতীয়তাবাদী এক রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আন্দোলন, যা বিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই মতবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো যেন এক কালো জাদুর মতো, যা সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। নেতা সেখানে একচ্ছত্র অধিপতি, যার কথাই শেষ কথা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকে কেন্দ্রীভূত, আর সামরিক শক্তি হয় অপ্রতিরোধ্য। বিরোধীদের জোরপূর্বক দমন করা হয়, যেন তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। ফ্যাসিবাদ বিশ্বাস করে এক প্রাকৃতিক সামাজিক অনুক্রমের উপর, যেখানে কিছু মানুষ জন্মগতভাবে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই মতবাদে ব্যক্তিমানুষের স্বপ্ন, সাধ, সব যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা; তার স্বাধীনতাকে তুচ্ছ করে, জাতি বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়। সমাজ ও অর্থনীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যেন সবকিছু এক নির্দিষ্ট ছাঁচে বাঁধা।
এই মতবাদ সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, উদারতাবাদ, বহুত্ববাদ এবং সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। রাজনৈতিক বর্ণালির সুদূর ডানদিকে এর অবস্থান । ফ্যাসিবাদ কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি একটি "সামাজিক নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র"। ব্যক্তিমানুষের স্বার্থকে জাতির স্বার্থের অধীন করা এবং বিরোধীদের জোরপূর্বক দমনের মাধ্যমে এটি একটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত সমাজ তৈরি করে। এটি কেবল শাসন নয়, এটি মানুষের মন ও আত্মাকে নিয়ন্ত্রণের এক সূক্ষ্ম কৌশল, যা ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এবং এমনকি চিন্তাভাবনাকেও রাষ্ট্রের বা জাতির ছাঁচে ফেলে দিতে চায়। এই দমন এতটাই গভীর যে, এটি সমাজকে একটি যন্ত্রের মতো পরিচালনা করতে চায়, যেখানে ব্যক্তি কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশ।
ফ্যাসিবাদ: সংজ্ঞার গোলকধাঁধা
পণ্ডিতদের চোখে ফ্যাসিবাদ: নানা মত, নানা পথ
ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করা যেন কুয়াশার মধ্যে পথ খোঁজা। ঐতিহাসিক ইয়ান কার্শো একবার বলেছিলেন, "ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা মানে যেন জেলিকে দেওয়ালে পেরেক দিয়ে আটকানোর চেষ্টা।" এই উক্তিটি ফ্যাসিবাদ নামক ধারণার একটি গভীর বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। প্রতিটি ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে, এবং প্রায়শই এর সংজ্ঞা হয় খুব ব্যাপক অথবা খুব সংকীর্ণ। পণ্ডিতেরা এই গোলকধাঁধায় পথ খুঁজেছেন নানাভাবে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, কারণ এর এই বিমূর্ততা এবং নমনীয়তা এটিকে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে সাহায্য করে। এটি একটি স্থির মতবাদ নয়, বরং একটি 'ছদ্মবেশী শক্তি' যা পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তন করে, যা এর টিকে থাকার অন্যতম কারণ। যদি ফ্যাসিবাদ একটি সুনির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয় মতাদর্শ হতো, তবে তাকে সহজে চিহ্নিত করা যেত এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হতো। কিন্তু এর "জেলি" সদৃশ নমনীয়তা বোঝায় যে এটি নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানিয়ে নিতে পারে। এটি তার মূল চরিত্রকে অক্ষুণ্ন রেখেও বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন করতে পারে। এই "ছদ্মবেশী" ক্ষমতা ফ্যাসিবাদকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে, কারণ এটি সহজে ধরা দেয় না।
স্ট্যানলি জি. পেইনের সংজ্ঞা: তিন স্তম্ভের ভিত্তি
স্ট্যানলি জি. পেইন, একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, ফ্যাসিবাদকে তিনটি মূল স্তম্ভের উপর দাঁড় করিয়েছেন, যা পণ্ডিতদের কাছে একটি গ্রহণীয় সংজ্ঞা হিসেবে প্রায়শই উদ্ধৃত হয়। তার মতে, ফ্যাসিবাদ কিছু বিষয়কে অস্বীকার করে, কিছু লক্ষ্য অর্জন করতে চায় এবং তার নিজস্ব একটি শৈলী আছে। এই তিন স্তম্ভ যেন ফ্যাসিবাদী ভবনের মূল কাঠামো।
প্রথমত, ফ্যাসিবাদী অস্বীকার
(Fascist negations) – ফ্যাসিবাদ উদারতাবাদ-বিরোধী, সাম্যবাদ-বিরোধী এবং রক্ষণশীলতা-বিরোধী। এটি কেবল যা অপছন্দ করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে না, বরং একটি নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরি করতে চায়।
দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিবাদী লক্ষ্য
(Fascist goals) – এর মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করতে এবং একটি আধুনিক, স্ব-নির্ধারিত সংস্কৃতির মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক রূপান্তর করতে একটি জাতীয়তাবাদী স্বৈরাচার তৈরি করা। এর পাশাপাশি, জাতিকে একটি সাম্রাজ্যে প্রসারিত করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
তৃতীয়ত, ফ্যাসিবাদী শৈলী
(Fascist style) – এটি রোমান্টিক প্রতীকবাদ, গণসংহতি, সহিংসতার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং পুরুষত্ব, তারুণ্য ও ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্বের প্রচারের একটি রাজনৈতিক নান্দনিকতা দ্বারা চিহ্নিত।
পেইনের সংজ্ঞা ফ্যাসিবাদকে কেবল তার "বিরোধিতা" (যা সে নয়) দ্বারা নয়, বরং তার "আকাঙ্ক্ষা" (যা সে হতে চায়) এবং "পদ্ধতি" (যেভাবে সে কাজ করে) দ্বারা চিহ্নিত করে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, কারণ এটি ফ্যাসিবাদকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে দেখার পাশাপাশি একটি সক্রিয়, গঠনমূলক (যদিও ধ্বংসাত্মক) শক্তি হিসেবেও তুলে ধরে। এর "গঠনমূলক" দিকটি (যদিও তার ফলাফল ধ্বংসাত্মক) ফ্যাসিবাদকে নিছক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শক্তি থেকে আলাদা করে। এটি বোঝায় যে ফ্যাসিবাদ একটি সুচিন্তিত, যদিও বিকৃত, সামাজিক প্রকৌশল।
উমবার্তো ইকো ও জেসন স্ট্যানলির দৃষ্টিভঙ্গি: চিরন্তন ফ্যাসিবাদ ও নেতার উপাসনা
উমবার্তো ইকো, ইতালির এক জ্ঞানী মানুষ, ফ্যাসিবাদকে "উর-ফ্যাসিবাদ" বা "চিরন্তন ফ্যাসিবাদ" বলে ডেকেছেন। তিনি বলেছেন, এর চৌদ্দটি বৈশিষ্ট্য আছে, যা হয়তো একে অপরের বিরুদ্ধে যায়, কিন্তু এর যেকোনো একটি উপস্থিত থাকলেই নাকি ফ্যাসিবাদ জন্ম নিতে পারে । ইকো'র এই ধারণাটি ফ্যাসিবাদের "গিরগিটি" সদৃশ প্রকৃতিকে তুলে ধরে। এটি বোঝায় যে ফ্যাসিবাদ একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি বিভিন্ন সামাজিক অসন্তোষের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে। এটি একটি স্থির মতবাদ নয়, বরং একটি 'ভাইরাস' এর মতো, যা বিভিন্ন হোস্টের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
জেসন স্ট্যানলি, তার 'হাউ ফ্যাসিবাদ ওয়ার্কস: দ্য পলিটিক্স অফ আস অ্যান্ড দেম' (২০১৮) বইয়ে, নেতার উপাসনাকে ফ্যাসিবাদের মূল শক্তি হিসেবে দেখেছেন। তার মতে, ফ্যাসিবাদ হলো "নেতার একটি উপাসনা, যিনি তথাকথিত সাম্যবাদী, মার্কসবাদী এবং সংখ্যালঘু ও অভিবাসীদের দ্বারা সৃষ্ট অপমানের মুখে জাতীয় পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেন... নেতা প্রস্তাব করেন যে কেবল তিনিই এটি সমাধান করতে পারেন এবং তার সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শত্রু বা বিশ্বাসঘাতক"। স্ট্যানলির "নেতার উপাসনা" এই অসন্তোষকে একটি একক কেন্দ্রে একত্রিত করার কৌশল। যখন মানুষ হতাশ থাকে, তখন তারা একজন শক্তিশালী নেতার উপর ভরসা করতে চায়, যিনি সব সমস্যার সমাধান করবেন। এই "নেতা-কেন্দ্রিকতা" ফ্যাসিবাদকে গণ-আন্দোলনে পরিণত করার মূল চাবিকাঠি। এটি ফ্যাসিবাদকে একটি "মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ" হিসেবে তুলে ধরে।
রজার গ্রিফিন ও রবার্ট প্যাক্সটনের ব্যাখ্যা: পুনর্জন্মের মিথ ও সম্প্রদায়ের পতন
রজার গ্রিফিন ফ্যাসিবাদকে "পুনর্জন্মমূলক জনতাবাদী অতি-জাতীয়তাবাদ" এর পৌরাণিক মূল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, ফ্যাসিবাদ জাতির পুনর্জন্মের এক স্বপ্ন দেখায়, যেখানে জাতি তার পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে। গ্রিফিন ফ্যাসিবাদকে তিনটি মূল উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেছেন: (i) পুনর্জন্মের মিথ, (ii) জনতাবাদী অতি-জাতীয়তাবাদ, এবং (iii) অবক্ষয়ের মিথ। তার মতে, "পুনর্জন্মমূলক অতি-জাতীয়তাবাদ ছাড়া প্রকৃত ফ্যাসিবাদ নেই"।
রবার্ট প্যাক্সটন আবার "সম্প্রদায়ের পতন" এবং "অপমানের" ধারণাকে ফ্যাসিবাদের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখেছেন। তিনি ফ্যাসিবাদকে "সম্প্রদায়ের পতন, অপমান বা শিকারিত্বের প্রতি আচ্ছন্নতা এবং ঐক্য, শক্তি ও বিশুদ্ধতার ক্ষতিপূরণমূলক উপাসনা দ্বারা চিহ্নিত রাজনৈতিক আচরণ" হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ফ্যাসিবাদ যেন এক আহত জাতির আর্তনাদ, যা প্রতিশোধ নিতে চায়।
গ্রিফিনের "পুনর্জন্মের মিথ" এবং প্যাক্সটনের "পতন ও অপমান" এর ধারণা ফ্যাসিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি উন্মোচন করে। ফ্যাসিবাদ কেবল রাজনৈতিক মতবাদ নয়, এটি একটি "সামাজিক নিরাময়ের প্রতিশ্রুতি" যা গভীর ক্ষত থেকে জন্ম নেয়। যখন একটি জাতি নিজেকে অপমানিত বা অবক্ষয়ের শিকার মনে করে, তখন ফ্যাসিবাদ তাদের সামনে এক জাদুকরী পুনর্জন্মের স্বপ্ন নিয়ে আসে। এটি কেবল ক্ষমতা দখলের কৌশল নয়, এটি মানুষের গভীরতম ভয় ও আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগানোর এক অন্ধকার শিল্প। "অবক্ষয়ের মিথ" এবং "সম্প্রদায়ের পতন, অপমান বা শিকারিত্বের প্রতি আচ্ছন্নতা" –
এই শব্দগুলো বোঝায় যে ফ্যাসিবাদ কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংকটের ফসল নয়, এটি একটি জাতির সম্মিলিত আত্মমর্যাদাবোধের সংকটের ফসল। যখন একটি জাতি নিজেদের "ক্ষতিগ্রস্ত" বা "দুর্বল" মনে করে, তখন তারা "পুনর্জন্মের মিথ" এর দিকে আকৃষ্ট হয়। ফ্যাসিবাদ এই মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতাকে পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা একে শক্তিশালী করে তোলে। এটি ফ্যাসিবাদকে একটি "আবেগ-ভিত্তিক" মতাদর্শ হিসেবে তুলে ধরে।
ফ্যাসিবাদী সংজ্ঞার তুলনামূলক চিত্র
ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করার জটিলতা এবং বিভিন্ন পণ্ডিতদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নজরে তুলে ধরার জন্য একটি তুলনামূলক সারণি খুবই মূল্যবান। এটি দেখাবে যে, সংজ্ঞায় ভিন্নতা থাকলেও, কিছু মূল উপাদান (যেমন: অতি-জাতীয়তাবাদ, কর্তৃত্ববাদ, সহিংসতা) প্রায় সব সংজ্ঞাতেই উপস্থিত। এটি "সংজ্ঞার গোলকধাঁধা" কে একটি স্পষ্ট এবং তুলনামূলক কাঠামো দেবে, যা পাঠকদের ফ্যাসিবাদকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
পণ্ডিতের নাম |
সংজ্ঞার মূল উপাদান/বৈশিষ্ট্য |
স্ট্যানলি জি. পেইন |
উদারবাদ-বিরোধী, সাম্যবাদ-বিরোধী, রক্ষণশীলতা-বিরোধী; জাতীয়তাবাদী স্বৈরাচার, সাম্রাজ্যবাদ; রোমান্টিক প্রতীকবাদ, গণসংহতি, সহিংসতার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব। |
সারণি ১: ফ্যাসিবাদী সংজ্ঞার তুলনামূলক চিত্র
ফ্যাসিবাদী দর্শনের মূল স্তম্ভ
জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্বাত্মক রাষ্ট্র: এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা
ফ্যাসিবাদ জাতির শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে, যেন জাতি এক অদৃশ্য দেবতা। এই শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রায়শই জাতিগত বিশুদ্ধতার সাথে মিশে যায়, যেখানে কিছু মানুষকে "শ্রেষ্ঠ" আর অন্যদের "নিকৃষ্ট" ভাবা হয়। নাৎসিবাদের ক্ষেত্রে এটি জাতিগত বিশুদ্ধতা এবং একটি প্রভু জাতির ধারণার সাথে মিশে গিয়েছিল, যেখানে ইহুদি এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য ও নির্যাতন করা হয়েছিল। রাষ্ট্র সেখানে সর্বময় কর্তা, যেন এক বিশাল ছায়া, যা সবকিছুকে ঢেকে রাখে। ফ্যাসিবাদ একটি সর্বাত্মক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচার করে। এই রাষ্ট্র উদার গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে, বহু-দলীয় ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং একটি এক-দলীয় রাষ্ট্রকে সমর্থন করতে পারে যাতে এটি জাতির সাথে সংশ্লেষিত হতে পারে।
মুসোলিনির 'দ্য ডকট্রিন অফ ফ্যাসিবাদ' (১৯৩২) বলে, "রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী ধারণা সর্বব্যাপী; এর বাইরে কোনো মানবিক বা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ থাকতে পারে না, এমনকি মূল্যও থাকতে পারে না।" এই উক্তিটি অতি-জাতীয়তাবাদ এবং সর্বাত্মক রাষ্ট্রের মধ্যেকার গভীর সংযোগকে স্পষ্ট করে তোলে। এর মানে হলো, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা ধারণ করে না, এটি মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের উপরও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। যখন জাতিকেই সর্বোচ্চ সত্তা হিসেবে দেখা হয়, তখন জাতির মূর্ত প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা মানে জাতির অস্তিত্বকেই প্রশ্ন করা। এই "পবিত্রকরণ" ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে এবং ভিন্নমতকে "জাতির শত্রু" হিসেবে চিহ্নিত করে, যা দমনকে ন্যায্যতা দেয়।
ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলো শিক্ষা ও গণমাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে সামাজিক মতাদর্শিকীকরণ নীতি অনুসরণ করে। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাসিবাদী আন্দোলনকে মহিমান্বিত করা এবং শিক্ষার্থীদের জাতির প্রতি এর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করা। এটি এমন ধারণাগুলোকে বর্জন করার চেষ্টা করে যা ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না এবং শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের প্রতি বাধ্য থাকতে শেখাত।
অর্থনীতির চালচিত্র: স্বনির্ভরতার স্বপ্ন ও বাস্তবতার টানাপোড়েন
ফ্যাসিবাদ অর্থনীতিকে দেখত এক খেলার মাঠ হিসেবে, যেখানে রাষ্ট্রই ছিল প্রধান খেলোয়াড়। তারা পুঁজিবাদের লোভ আর সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদ, দুটোরই বিরোধিতা করত, নিজেদেরকে উভয় আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র এবং মুক্ত-বাজার অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করত। তাদের স্বপ্ন ছিল এক স্বনির্ভর জাতি, যা কারো মুখাপেক্ষী হবে না। এই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, যা স্বায়ত্তশাসন
(autarky) নামে পরিচিত, বেশিরভাগ ফ্যাসিবাদী সরকারের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল।
ফ্যাসিবাদী সরকারগুলি সাধারণত বড় ব্যবসা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে, এবং ব্যবসাকে সরকারের স্বার্থ পরিবেশন করার প্রত্যাশা করা হয়। ফ্যাসিবাদ অভ্যন্তরীণ শ্রেণী সংঘাতের সমাধানের পক্ষে ছিল যাতে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত হয়। এটি "পরজীবী পুঁজিবাদ" এর নিন্দা করে, তবে "উৎপাদনশীল পুঁজিবাদ" কে স্বাগত জানায় যতক্ষণ না তা জাতীয় উদ্দেশ্যকে সমর্থন করে। এই পার্থক্যটি নিছক অর্থনৈতিক বিভাজন নয়, এটি একটি আদর্শিক বিভাজন। ফ্যাসিবাদ "উৎপাদনশীল" বলতে তাদের বোঝায় যারা রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করে (যেমন: যুদ্ধ উৎপাদন), আর "পরজীবী" বলতে তাদের বোঝায় যারা কেবল ব্যক্তিগত লাভের জন্য কাজ করে এবং রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল নয়। এই ধারণার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এটি বোঝায় যে ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি কেবল স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখায় না, এটি রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে প্রসারিত করে।
মুসোলিনি ১৯৩৪ সালে ঘোষণা করেন যে ইতালীয় অর্থনীতির তিন-চতুর্থাংশ, শিল্প ও কৃষি উভয়ই, রাষ্ট্রের হাতে ছিল। হিটলারও "উৎপাদনশীল পুঁজিবাদ"
(bodenständigen Kapitalismus) সমর্থন করতেন, যা নিজের শ্রম থেকে অর্জিত লাভের উপর ভিত্তি করে ছিল, কিন্তু "অনুৎপাদনশীল পুঁজিবাদ" বা ঋণ পুঁজিবাদের নিন্দা করতেন, যা ফটকাবাজি থেকে লাভ অর্জন করত। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতি একটি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিকে সমর্থন করত যা উৎপাদন উপায়ের উপর ব্যক্তিগত ও সরকারি মালিকানার মিশ্রণ গ্রহণ করত। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে প্রয়োগ করা হতো, এবং বেসরকারি উদ্যোগের সমৃদ্ধি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলির সাথে নিজেদের সমন্বয় করার উপর নির্ভরশীল ছিল।
প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ ও সহিংসতার মন্ত্র: শক্তির উপাসনা
ফ্যাসিবাদ বিশ্বাস করে, শক্তিই সত্য। তাই তারা প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ এবং সহিংসতাকে তাদের রাজনীতির মূল অংশ মনে করে। তাদের কাছে জীবন এক অনন্ত সংগ্রাম, আর এই সংগ্রামে টিকে থাকতে হলে সহিংসতা অপরিহার্য। এই রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যবহারের উপর জোর দেওয়ার অর্থ হল যে বেশিরভাগ ফ্যাসিবাদী দল তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত মিলিশিয়াও তৈরি করেছে, যেমন নাৎসি পার্টির ব্রাউনশার্টস এবং ফ্যাসিবাদী ইতালির ব্ল্যাকশার্টস।
সহিংসতার প্রতি ফ্যাসিবাদীদের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ক্ষমতা দখলের কৌশল নয়, এটি তাদের গভীর সামাজিক ডারউইনবাদী বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত। তারা বিশ্বাস করে যে জাতি ও সমাজকে টিকে থাকতে হলে "দুর্বল" বা "অবক্ষয়িত" উপাদানগুলো থেকে নিজেদেরকে "শুদ্ধ" করতে হবে। এই ধারণা সহিংসতাকে একটি "শুদ্ধিকরণের যন্ত্র" হিসেবে বৈধতা দেয়, যা জাতির পুনর্জন্মের জন্য অপরিহার্য। যদি সমাজ ডারউইনবাদী হয় এবং কেবল "সবচেয়ে যোগ্যতম"রাই টিকে থাকে, তবে "দুর্বল" বা "অবাঞ্ছিত" দের নির্মূল করাকে সেই মতাদর্শের অনুসারীরা "প্রাকৃতিক" এবং "জাতির মঙ্গলের জন্য" হিসেবে দেখে। এই চিন্তাভাবনা সহিংসতাকে একটি নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি দেয়, যা এটিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে। এটি বোঝায় যে ফ্যাসিবাদী সহিংসতা নিছক বর্বরতা নয়, এটি একটি বিকৃত আদর্শের বাস্তবায়ন।
যৌবন ও লিঙ্গভূমিকার চিত্রকল্প: এক নতুন সমাজের স্বপ্ন
ফ্যাসিবাদ তারুণ্যকে পূজা করে, যেন তারাই জাতির ভবিষ্যৎ। তারা বিশ্বাস করে, তরুণরাই পারে জাতিকে নতুন করে গড়তে। ইতালীয় ফ্যাসিবাদীদের রাজনৈতিক সঙ্গীতকে 'জোভিজ্জেজা' (তারুণ্য) বলা হতো। ফ্যাসিবাদ তারুণ্যের শারীরিক বয়স এবং আধ্যাত্মিক অর্থে বীরত্ব ও কর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতি উভয় ক্ষেত্রেই জোর দেয়।
নারী ও পুরুষের ভূমিকা সেখানে সুনির্দিষ্ট, যেন এক প্রাচীন নাটকের চরিত্র। মুসোলিনি নারীর প্রাথমিক ভূমিকা সন্তান জন্মদানকারী হিসেবে এবং পুরুষের ভূমিকা যোদ্ধা হিসেবে দেখতেন, একবার বলেছিলেন, "যুদ্ধ পুরুষের জন্য যা, মাতৃত্ব নারীর জন্য তা।" জন্মহার বাড়ানোর প্রচেষ্টায়, ইতালীয় ফ্যাসিবাদী সরকার বড় পরিবার পালনকারী নারীদের আর্থিক প্রণোদনা দেয় এবং কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কমানোর নীতি শুরু করে। ১৯৩৪ সালে মুসোলিনি ঘোষণা করেন যে নারীদের কর্মসংস্থান বেকারত্বের একটি প্রধান দিক এবং পুরুষদের বেকারত্বের সমাধান হল কর্মশক্তি থেকে নারীদের "প্রস্থান"। নাৎসি জার্মান সরকার নারীদের বাড়িতে থেকে সন্তান জন্মদান এবং ঘর রক্ষণাবেক্ষণে উৎসাহিত করে।
ফ্যাসিবাদীদের লিঙ্গ ভূমিকা এবং তারুণ্যের উপর জোর দেওয়া কেবল ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন নয়, এটি একটি "প্রজননমূলক জাতীয়তাবাদ" এর অংশ। জাতির শক্তি ও পুনর্জন্মের জন্য "জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ" জনসংখ্যার বৃদ্ধি অপরিহার্য। তাই নারীদেহের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং পুরুষত্বের উপাসনা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের একটি মৌলিক কৌশল, যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে ব্যক্তিগত জীবনের গভীরে প্রবেশ করায়। নাৎসিরা সমকামিতাকে "অবক্ষয়িত,"
"স্ত্রীসুলভ," "বিকৃত" এবং পুরুষত্বকে ক্ষুণ্ণকারী বলে মনে করত কারণ এটি সন্তান উৎপাদন করে না। খোলাখুলি সমকামীদের নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটক করা হতো।
ফ্যাসিবাদ ও অন্যান্য মতাদর্শের পার্থক্য
ফ্যাসিবাদ নিজেকে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র এবং মুক্ত-বাজার অর্থনীতি উভয়ের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করে, যা এটিকে অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করতে সাহায্য করে। এই সারণিটি ফ্যাসিবাদকে "তৃতীয় পথ" হিসেবে তার নিজস্ব দাবির প্রেক্ষাপটে তুলে ধরবে এবং এর অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হাইলাইট করবে। পাঠকরা সহজেই বুঝতে পারবে ফ্যাসিবাদ কেন সাম্যবাদ, গণতন্ত্র বা উদারতাবাদের মতো মতাদর্শের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে।
বৈশিষ্ট্য |
ফ্যাসিবাদ |
সাম্যবাদ |
উদারতাবাদ |
রক্ষণশীলতা |
রাষ্ট্রের ভূমিকা |
সর্বাত্মক, একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী, জাতির মূর্ত প্রতীক। |
সর্বাত্মক, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যন্ত্র। |
সীমিত, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষাকারী। |
ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষাকারী। |
ব্যক্তির স্থান |
জাতির বা গোষ্ঠীর স্বার্থের অধীন, ব্যক্তিগত স্বার্থ তুচ্ছ। |
শ্রেণীর স্বার্থের অধীন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপ। |
ব্যক্তি স্বাধীনতা, অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনকে মূল্য দেয়। |
ঐতিহ্যবাহী সামাজিক কাঠামো ও মূল্যবোধের অধীন। |
অর্থনীতি |
রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত, স্বায়ত্তশাসন
(autarky), উৎপাদনশীল পুঁজিবাদকে সমর্থন। |
রাষ্ট্রীয় মালিকানা, শ্রেণীহীন অর্থনীতি, সম্পদের সমবণ্টন। |
মুক্ত বাজার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সীমিত সরকারি হস্তক্ষেপ। |
ঐতিহ্যবাহী অর্থনৈতিক কাঠামো, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, স্থিতিশীলতা। |
সহিংসতা |
রাজনৈতিক সহিংসতার বৈধতা, জাতীয় পুনর্জন্মের মাধ্যম। |
বিপ্লবের জন্য সহিংসতা অপরিহার্য, শ্রেণী সংগ্রাম। |
সাধারণত শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, আইনের শাসন। |
সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সীমিত বলপ্রয়োগ। |
সামাজিক অনুক্রম |
প্রাকৃতিক সামাজিক অনুক্রম, শ্রেষ্ঠ জাতির ধারণা। |
শ্রেণীহীন সমাজ, সাম্যবাদ। |
আইনি সমতা, সুযোগের সমতা। |
ঐতিহ্যবাহী সামাজিক স্তরবিন্যাস, স্থিতিশীলতা। |
জাতীয়তাবাদ |
অতি-জাতীয়তাবাদ, পুনর্জন্মের মিথ, সাম্রাজ্যবাদ। |
আন্তর্জাতিকতাবাদ (শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য)। |
উদার জাতীয়তাবাদ, বিশ্বজনীন মূল্যবোধ। |
ঐতিহ্যবাহী জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ। |
সারণি ২: ফ্যাসিবাদ ও অন্যান্য মতাদর্শের পার্থক্য
ফ্যাসিবাদী শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য
ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা তার মতাদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো কেবল তাত্ত্বিক সংজ্ঞা নয়, বরং ফ্যাসিবাদী শাসনের ব্যবহারিক দিকগুলো তুলে ধরে। পাঠকরা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মূল কার্যপ্রণালী এবং তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাবে।
বৈশিষ্ট্য |
ব্যাখ্যা/উদাহরণ |
একনায়কতান্ত্রিক নেতা |
একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা, যার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ এবং যিনি নিজেকে জাতির একমাত্র ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করেন। উদাহরণ: ইতালিতে বেনিটো মুসোলিনি, জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার। |
কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচার |
রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, যেখানে কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। |
সামরিকবাদ |
সামরিক শক্তিকে জাতির গৌরব ও পুনর্জন্মের মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকে উৎসাহিত করা হয়। |
বিরোধীদের দমন |
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ভিন্নমতাবলম্বী এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের জোরপূর্বক দমন করা হয়, প্রায়শই সহিংসতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে। উদাহরণ: ব্ল্যাকশার্টস (ইতালি), ব্রাউনশার্টস (জার্মানি)। |
প্রাকৃতিক সামাজিক অনুক্রম |
সমাজে কিছু মানুষের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করা হয়, যা প্রায়শই জাতিগত বা বর্ণগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার সাথে যুক্ত। |
ব্যক্তিগত স্বার্থের অধীনতা |
ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও স্বাধীনতাকে জাতির বা রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের কাছে তুচ্ছ করা হয়। |
সমাজ ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ |
রাষ্ট্রের দ্বারা সমাজ ও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্র কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে জাতীয় লক্ষ্য অর্জন করা যায়। |
সর্বাত্মক এক-দলীয় রাষ্ট্র |
একটি একক রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। |
স্বায়ত্তশাসন
(Autarky) |
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য, যেখানে একটি জাতি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা নিজেরাই পূরণ করতে চায়। |
সম্প্রসারণবাদ |
জাতির ঐতিহাসিক গৌরব পুনরুদ্ধার বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য দেশের ভূখণ্ড দখল বা প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা। উদাহরণ: মুসোলিনির রোমান সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা, হিটলারের লেবেনস্রাউম নীতি। |
নেতার উপাসনা |
নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও ভক্তি প্রচার করা হয়, তাকে জাতির প্রতীক ও ত্রাণকর্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়। |
পুনর্জন্মমূলক অতি-জাতীয়তাবাদ |
জাতির অবক্ষয় থেকে পুনর্জন্মের মিথ প্রচার করা হয়, যেখানে জাতিকে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়। |
সহিংসতার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি |
সহিংসতাকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি বৈধ ও প্রয়োজনীয় মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। |
সামাজিক মতাদর্শিকীকরণ |
শিক্ষা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ প্রচার করা হয়, ভিন্নমতকে দমন করা হয়। |
প্রজননমূলক জাতীয়তাবাদ |
জন্মহার বৃদ্ধি এবং ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গ ভূমিকা (নারী জননী, পুরুষ যোদ্ধা) প্রচার করা হয়, জাতিগত বিশুদ্ধতা বজায় রাখার লক্ষ্যে। |
সারণি ৩: ফ্যাসিবাদী শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য
ইতিহাসের পাতায় ফ্যাসিবাদ: জন্ম থেকে মহাযুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদী উন্মেষ: এক নতুন ভোরের ইঙ্গিত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সে এক অদ্ভুত যুদ্ধ ছিল। শুধু মানুষ মরেনি, পুরোনো পৃথিবীটাও মরে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের উপরই ফ্যাসিবাদ তার প্রথম আলো দেখেছিল। ১৯১৪ সালের আগস্টে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন ইতালির রাজনৈতিক বামপন্থীরা যুদ্ধের বিষয়ে গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কিছু বিপ্লবী সিন্ডিক্যালিস্ট, যারা যুদ্ধের শুরুতে দ্বিধাবিভক্ত ছিল, তারাই এক নতুন পথের ইঙ্গিত দিল। তারা জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির প্রতিক্রিয়াশীল শাসনব্যবস্থাকে পরাজিত করার জন্য যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জানায়, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে এটি সমাজতন্ত্রের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। অ্যাঞ্জেলো অলিভিয়েরো অলিভেত্তি ১৯১৪ সালের অক্টোবরে 'বিপ্লবী ফ্যাসিস অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন' নামে একটি যুদ্ধ-সমর্থক ফ্যাসিয়ো গঠন করেন। বেনিটো মুসোলিনি, যিনি একসময় ইতালীয় সোশ্যালিস্ট পার্টির সংবাদপত্র 'আভান্তি!' এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন, তার জার্মান-বিরোধী অবস্থানের জন্য বহিষ্কৃত হয়ে একটি পৃথক ফ্যাসিয়োতে এই হস্তক্ষেপবাদী কারণের সাথে যোগ দেন । 'ফ্যাসিবাদ' শব্দটি প্রথম ১৯১৫ সালে মুসোলিনির আন্দোলন, 'ফ্যাসিস অফ রেভোলিউশনারি অ্যাকশন' এর সদস্যরা ব্যবহার করেন।
ফ্যাসিবাদীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে একটি বিপ্লব হিসেবে দেখেছিল যা যুদ্ধ, সমাজ, রাষ্ট্র এবং প্রযুক্তির প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। এই যুদ্ধের "মোট যুদ্ধ" ধারণাটি কেবল যুদ্ধের প্রকৃতি পরিবর্তন করেনি; এটি ব্যক্তিজীবন এবং সম্পদের উপর অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে স্বাভাবিক করে তুলেছিল। এটি সর্বাত্মক রাষ্ট্রের জন্য একটি নীলনকশা তৈরি করে এবং বেসামরিক ও যোদ্ধাদের মধ্যেকার সীমা রেখা মুছে দেয়, যা ফ্যাসিবাদীরা পরবর্তীতে শোষণ ও নিখুঁত করে তোলে। মোট যুদ্ধ এবং সমাজের গণসংহতি বেসামরিক এবং যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য মুছে ফেলেছিল, কারণ বেসামরিকরাও যুদ্ধ প্রচেষ্টার জন্য অর্থনৈতিক উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। এভাবেই "সামরিক নাগরিকত্ব" এর ধারণা উদ্ভূত হয়, যেখানে যুদ্ধের সময় সকল নাগরিক কোনো না কোনোভাবে সামরিক বাহিনীর সাথে জড়িত ছিল। যুদ্ধ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান ঘটিয়েছিল যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে রণাঙ্গনে কাজ করার জন্য বা রণাঙ্গনে যারা ছিল তাদের সমর্থন করার জন্য অর্থনৈতিক উৎপাদন ও লজিস্টিক সরবরাহ করার জন্য একত্রিত করতে সক্ষম ছিল, এবং নাগরিকদের জীবনে হস্তক্ষেপ করার জন্য অভূতপূর্ব ক্ষমতা ছিল। এই অভিজ্ঞতা ফ্যাসিবাদীদের জন্য একটি প্রস্তুত ক্ষেত্র তৈরি করে, যেখানে তারা ব্যক্তিমানুষের উপর রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণকে সহজেই প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
ইতালিতে মুসোলিনির উত্থান: ক্ষমতার মায়াজাল
মুসোলিনি, এক রহস্যময় যাদুকরের মতো, ইতালির রাজনীতিতে আবির্ভূত হলেন। ১৯১৯ সালে তিনি মিলানে 'ইতালীয় ফ্যাসিস অফ কমব্যাট' প্রতিষ্ঠা করেন, যা দুই বছর পর 'ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি'তে পরিণত হয়। ১৯২০ সালে, শিল্প শ্রমিকদের দ্বারা জঙ্গি ধর্মঘট কার্যকলাপ ইতালিতে তার শীর্ষে পৌঁছেছিল এবং ১৯১৯ ও ১৯২০ সাল 'রেড ইয়ার'
(Biennio Rosso) নামে পরিচিত ছিল। এই পরিস্থিতিতে মুসোলিনি শিল্পপতিদের সাথে হাত মেলালেন, ইতালিতে শৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার নামে শ্রমিক ও কৃষকদের উপর আক্রমণ চালিয়ে পরিস্থিতির সুবিধা নেন। তিনি যেন এক দক্ষ অভিনেতা, যিনি পরিস্থিতি বুঝে নিজের চরিত্র পাল্টে ফেলতেন। ফ্যাসিবাদ ইতালীয় রক্ষণশীলদের কাছে আবেদন জানানোর জন্য তার রাজনৈতিক এজেন্ডায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে—তার পূর্ববর্তী জনতাবাদ, প্রজাতন্ত্রবাদ এবং ধর্ম-বিরোধীতা ত্যাগ করে, মুক্ত উদ্যোগের সমর্থনে নীতি গ্রহণ করে এবং ক্যাথলিক চার্চ ও রাজতন্ত্রকে ইতালির প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করে।
ফ্যাসিবাদ একটি ছোট, শহুরে, জনতাবাদী আন্দোলন থেকে একটি গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী অভিজাতদের (ভূস্বামী, বড় ব্যবসা, ক্যাথলিক চার্চ, রাজতন্ত্র) সাথে কৌশলগত সমঝোতার মাধ্যমে। এই কৌশলগত সুবিধাবাদ ফ্যাসিবাদকে একটি "Chameleon"
মতাদর্শে পরিণত করে, যা তার মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেকোনো বাহ্যিক রূপ ধারণ করতে পারে। ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক অধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার পর, ১৯২১ সালের মধ্যে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৫০,০০০-এ পৌঁছে যায়।
১৯২২ সালের ২৪ অক্টোবর, ফ্যাসিবাদী পার্টি নেপলসে তার বার্ষিক কংগ্রেস করে, যেখানে মুসোলিনি ব্ল্যাকশার্টদের সরকারি ভবন এবং ট্রেন দখল করতে এবং রোমের চারপাশে তিনটি স্থানে একত্রিত হতে নির্দেশ দেন। ইতালির সরকার, একটি বামপন্থী জোটের নেতৃত্বে, অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত ছিল এবং ফ্যাসিবাদী অগ্রগতির প্রতিক্রিয়া জানাতে অক্ষম ছিল। ইতালির রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল রোমে রক্তপাতের ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন এবং মুসোলিনিকে ইতালির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। মুসোলিনি ৩০ অক্টোবর রোমে এসে নিয়োগ গ্রহণ করেন। ফ্যাসিবাদী প্রচার এই ঘটনাকে, যা 'মার্চ অন রোম' নামে পরিচিত, ফ্যাসিবাদীদের বীরত্বপূর্ণ শোষণের কারণে ক্ষমতা দখল হিসেবে মহিমান্বিত করে।
জার্মানিতে হিটলারের ছায়া: এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা
ইতালির ফ্যাসিবাদ যখন জেঁকে বসছে, তখন জার্মানিতে এক নতুন অন্ধকারের ছায়া পড়ছিল। অ্যাডলফ হিটলার, মুসোলিনির এক মুগ্ধ ভক্ত, ইতালীয় মডেল অনুসরণ করে নাৎসি পার্টিকে গড়ে তুললেন। হিটলারের মুসোলিনিকে অনুসরণ করা কেবল একটি অনুকরণ ছিল না; এটি ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের "সংক্রামক" প্রকৃতিকে প্রকাশ করে। একটি সফল মডেল অন্য একটি দেশে কীভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিশেষত যখন সেই দেশে অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক অস্থিরতা থাকে, তা এর মাধ্যমে বোঝা যায়। হিটলার এবং জার্মান যুদ্ধ নায়ক এরিক লুডেনডর্ফ-এর নেতৃত্বে নাৎসিরা 'মার্চ অন রোম' এর অনুকরণে 'মার্চ অন বার্লিন' এর চেষ্টা করেছিল, যার ফলস্বরূপ ১৯২৩ সালের নভেম্বরে মিউনিখে ব্যর্থ 'বিয়ার হল পুটশ' হয়।
১৯৩৩ সালে হিটলার এবং নাৎসিদের ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে জার্মানিতে উদার গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং নাৎসিরা দেশকে যুদ্ধের জন্য একত্রিত করে, বেশ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে সম্প্রসারণবাদী আঞ্চলিক লক্ষ্য নিয়ে। ১৯৩০-এর দশকে, নাৎসিরা জাতিগত আইন প্রয়োগ করে যা ইচ্ছাকৃতভাবে ইহুদি এবং অন্যান্য জাতিগত ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য, ভোটাধিকার হরণ এবং নির্যাতন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, নাৎসি জার্মানির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী অক্ষশক্তির গণহত্যা এবং সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ডের কারণ হয়। হলোকাস্ট ছিল এই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার এক ভয়াবহ পরিণতি, যেখানে ইহুদিদের একটি জাতি হিসেবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদী পতন: এক রক্তাক্ত সমাপ্তি
ফ্যাসিবাদী শক্তির উন্মত্ততা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকে এক ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিল। ১৯৪০ সালে মুসোলিনি ইতালিতে অক্ষশক্তির পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মানব ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়, ফ্যাসিবাদী অক্ষশক্তির পতন ডেকে আনলো। এই যুদ্ধে নাৎসি জার্মানির নেতৃত্বে ইউরোপের অক্ষশক্তি হলোকাস্ট নামে পরিচিত গণহত্যায় লক্ষ লক্ষ পোল, ইহুদি, জিপসি এবং অন্যান্যদের নির্মূলে অংশ নেয়।
ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং গণহত্যার সরাসরি পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক বা সামরিক সংঘাত ছিল না, এটি ছিল ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের চূড়ান্ত এবং ধ্বংসাত্মক রূপের প্রকাশ। ১৯৪৩ সালে ইতালির একাধিক সামরিক ব্যর্থতা, জার্মানির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা, মিত্রশক্তির ইতালি আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক অপমান এর মুখে মুসোলিনিকে সরকার প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েলের আদেশে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে ভেঙে দেন এবং ইতালির মিত্রশক্তির পক্ষে আনুগত্য পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। মুসোলিনিকে জার্মান বাহিনী গ্রেপ্তার থেকে উদ্ধার করে এবং ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মান ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র, ইতালীয় সোশ্যাল রিপাবলিকের নেতৃত্ব দেন।
১৯৪৫ সালের ২৮ এপ্রিল, মুসোলিনিকে ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টিসানরা ধরে নিয়ে হত্যা করে। এর দুই দিন পর, ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫ সালে হিটলার আত্মহত্যা করেন। এর অল্প সময়ের মধ্যেই জার্মানি আত্মসমর্পণ করে এবং দখলদার মিত্রশক্তি দ্বারা নাৎসি শাসনব্যবস্থা পদ্ধতিগতভাবে ভেঙে দেওয়া হয়। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল পরবর্তীতে আহ্বান করা হয়, যেখানে ১৯৪৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত অসংখ্য নাৎসি রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক নেতাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়, এবং অনেক গুরুতর অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যুদ্ধের সমাপ্তি ফ্যাসিবাদকে বিশ্ব মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিলেও, এর দ্বারা সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় এবং নৈতিক পতন মানব ইতিহাসের এক স্থায়ী ক্ষত হিসেবে রয়ে গেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য এক নির্মম সতর্কতা।
ফ্যাসিবাদ: সমালোচনার আয়না
গণতন্ত্রের শত্রু ও স্বৈরাচারের রূপ: এক নির্মম বাস্তবতা
ফ্যাসিবাদকে যখন সমালোচনার আয়নায় দেখা হয়, তখন তার আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে। সে চেহারা বড়ই কুৎসিত, বড়ই নির্মম। ফ্যাসিবাদ ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্র-বিরোধী। এর চরম কর্তৃত্ববাদ এবং জাতীয়তাবাদ প্রায়শই জাতিগত বিশুদ্ধতা বা একটি প্রভু জাতির বিশ্বাস হিসেবে প্রকাশ পায়, যা সাধারণত বর্ণবাদ বা ইহুদি, সমকামী, রূপান্তরকামী, জাতিগত সংখ্যালঘু বা অভিবাসীদের মতো "দানবীয় অন্য" এর বিরুদ্ধে বৈষম্যের সাথে মিশ্রিত হয়।
এই ধারণাগুলো ফ্যাসিবাদী শাসনকে গণহত্যা, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, নির্বাসন এবং গণহত্যার দিকে চালিত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ফ্যাসিবাদী অক্ষশক্তির গণহত্যা এবং সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ডের কারণ হয় । ফেডেরিকো ফিঙ্কেলস্টেইন লিখেছেন যে ফ্যাসিবাদ "সর্বাত্মকতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ এবং, জার্মান ক্ষেত্রে, গত শতাব্দীর সবচেয়ে চরম গণহত্যা—হলোকাস্টকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।" তার মতে, "ফ্যাসিবাদ, তার অনেক রূপে, আদর্শিক ও রাজনৈতিক সমাপ্তির সন্ধানে তার নিজস্ব নাগরিকদের পাশাপাশি তার উপনিবেশিক প্রজাদের হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের চূড়ান্ত সময়ে ইউরোপ এবং তার বাইরে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল।"
চরম অতি-জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত বিশুদ্ধতার ধারণার সাথে গণহত্যার একটি অন্তর্নিহিত যোগসূত্র রয়েছে। এটি কোনো আকস্মিক উপজাত নয়, বরং ফ্যাসিবাদের মূল মতাদর্শের একটি যৌক্তিক পরিণতি। যদি একটি মতাদর্শ বিশ্বাস করে যে একটি জাতি বা গোষ্ঠী অন্য সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা অপরিহার্য, তবে যারা এই বিশুদ্ধতার জন্য "হুমকি" বা "বাধা", তাদের নির্মূল করাকে সেই মতাদর্শের অনুসারীরা "ন্যায্য" মনে করবে। এটি ফ্যাসিবাদী সহিংসতার একটি গভীর আদর্শিক ভিত্তি।
সুবিধাবাদ ও আদর্শিক ভণ্ডামি: মুখোশের আড়ালে
মুসোলিনি নাকি গিরগিটির মতো রঙ বদলাতেন। আজ এক কথা, কাল আরেক কথা। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল একটাই – ক্ষমতা। ইতালীয় ফ্যাসিবাদীদের কিছু সমালোচক বলেছেন যে, এর বেশিরভাগ মতাদর্শ মুসোলিনির নীতিহীন সুবিধাবাদের ফল ছিল এবং তিনি কেবল তার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ানোর জন্য তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করতেন। রিচার্ড ওয়াশবার্ন চাইল্ড, যিনি মুসোলিনির বন্ধু ও প্রশংসক ছিলেন, মুসোলিনির সুবিধাবাদী আচরণকে এই বলে রক্ষা করেছিলেন যে মুসোলিনি বিশ্বাস করতেন মানবতাকে স্থির তত্ত্বের পরিবর্তে পরিবর্তনশীল অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। চাইল্ড মুসোলিনিকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, "একটি মতবাদের পবিত্রতা মতবাদে নয়; এর ক্ষমতা, কাজ, বাস্তবে সফল হওয়ার ক্ষমতা ছাড়া এর কোনো পবিত্রতা নেই। এটি গতকাল সফল হতে পারে এবং আগামীকাল ব্যর্থ হতে পারে। গতকাল ব্যর্থ হতে পারে এবং আগামীকাল সফল হতে পারে। যন্ত্রটি, সবার আগে, চলতে হবে!"
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের সময় মুসোলিনির কাজকে সুবিধাবাদী হিসেবে সমালোচনা করা হয়েছে, কারণ তিনি মার্কসবাদী সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদ ত্যাগ করে অ-সাম্যবাদী জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেছিলেন। এই পরিবর্তনের পর, মুসোলিনি এবং নতুন ফ্যাসিবাদী আন্দোলন ইতালীয় ও বিদেশী উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল, যেমন আনসালডো (একটি অস্ত্রশস্ত্র সংস্থা) এবং অন্যান্য সংস্থা। এমনকি ব্রিটিশ সিকিউরিটি সার্ভিস এমআই৫ থেকেও সহায়তা পেয়েছিল । তবে, তার সংবাদপত্র 'ইল পোপোলো ডি'ইতালিয়া'-তে তিনি তার আর্থিক পৃষ্ঠপোষকদের পূর্বানুমতি ছাড়াই যা খুশি লিখতে পারতেন। মুসোলিনির মার্কসবাদ থেকে ফ্যাসিবাদে রূপান্তর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই শুরু হয়েছিল, কারণ তিনি মার্কসবাদ এবং সাম্যবাদ সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং ফ্রিডরিখ নিটশের মতো সাম্যবাদ-বিরোধী ব্যক্তিত্বদের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন দেখাচ্ছিলেন।
ফ্যাসিবাদীদের আদর্শিক পরিবর্তন (যেমন মুসোলিনির মার্কসবাদ থেকে জাতীয়তাবাদে পরিবর্তন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্থিক সহায়তা গ্রহণ, নাৎসিবাদের প্রতি তার অবস্থান পরিবর্তন, এবং ইহুদি-বিরোধিতার দেরিতে গ্রহণ) ফ্যাসিবাদকে একটি সুসংগত দর্শন নয়, বরং ক্ষমতা অর্জন ও বজায় রাখার একটি "পদ্ধতি" হিসেবে প্রকাশ করে। এটি তার বাগ্মিতাকে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রয়োজনে মানিয়ে নেয়।
জার্মান নাৎসিবাদের সাথে ইতালীয় ফ্যাসিবাদীদের সম্পর্কও ছিল এমনই, কখনো মিত্র, কখনো শত্রু। ইতালীয় ফ্যাসিবাদী সম্পর্ক ১৯২০-এর দশকের শেষ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সমর্থনমূলক ছিল, যখন হিটলারের ক্ষমতায় আগমন এবং মুসোলিনির সাথে হিটলারের প্রথম সাক্ষাৎ উদযাপিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত বিরোধিতা দেখা যায়, যখন অস্ট্রিয়ান নাৎসিদের দ্বারা ইতালির মিত্র অস্ট্রিয়ার নেতা এঙ্গেলবার্ট ডলফুসের হত্যাকাণ্ড ঘটে। আবার ১৯৩৬ সালের পর সমর্থন ফিরে আসে, যখন জার্মানিই একমাত্র উল্লেখযোগ্য শক্তি ছিল যারা ইতালির ইথিওপিয়া আক্রমণ ও দখলকে নিন্দা করেনি।
মুসোলিনি এবং ইতালীয় ফ্যাসিবাদীরা নাৎসিবাদের জাতিগত তত্ত্বের নিন্দা ও উপহাস করে, বিশেষ করে এর নর্ডিসিজমের নিন্দা করে এবং ভূমধ্যসাগরীয়বাদের প্রচার করে। ১৯৩৮ সালে মুসোলিনি ঘোষণা করেন যে ইতালীয় ফ্যাসিবাদ সবসময়ই ইহুদি-বিরোধী ছিল, যদিও ইতালীয় ফ্যাসিবাদ ১৯৩০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত ইহুদি-বিরোধিতা সমর্থন করেনি। এই ধারাবাহিক "আদর্শিক ভণ্ডামি" বোঝায় যে ফ্যাসিবাদ কোনো স্থির মতাদর্শ নয়, এটি একটি "ক্ষমতা-কেন্দ্রিক" কৌশল। এর মূল লক্ষ্য ক্ষমতা দখল ও ধরে রাখা, এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটি তার আদর্শিক অবস্থানকে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করতে পারে। এটি ফ্যাসিবাদকে একটি "প্রতারণামূলক" শক্তি হিসেবে তুলে ধরে।
ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলন: প্রতিরোধের গল্প
প্রতিরোধের জন্ম: এক সম্মিলিত কণ্ঠস্বর
ফ্যাসিবাদ যখন তার কালো ছায়া ফেলছিল, তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়াল একদল মানুষ। তারা ছিল নানা মতের, নানা পথের, কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল এক – অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালানো। ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা হল ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। এটি ১৯২০-এর দশকে ইউরোপীয় দেশগুলিতে শুরু হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে এবং সময়কালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেখানে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে অনেক দেশ মিত্রশক্তি গঠন করে এবং বিশ্বজুড়ে কয়েক ডজন প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিক বর্ণালির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে, যার মধ্যে নৈরাজ্যবাদ, সাম্যবাদ, শান্তিবাদ, প্রজাতন্ত্রবাদ, সমাজতন্ত্র, সিন্ডিক্যালিজম, এবং কেন্দ্রপন্থী, রক্ষণশীল, উদারপন্থী ও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের এই বিস্তৃত আদর্শিক পরিসর প্রমাণ করে যে ফ্যাসিবাদ কেবল বামপন্থী রাজনীতিকে নয়, বরং বিভিন্ন সামাজিক মূল্যবোধের জন্য একটি মৌলিক হুমকি সৃষ্টি করে, যা অপ্রত্যাশিত জোটকে বাধ্য করে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ফ্যাসিবাদের হুমকি প্রচলিত রাজনৈতিক বিভেদকে ছাড়িয়ে যায়। যখন রক্ষণশীল এবং উদারপন্থীরাও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়, তখন বোঝা যায় যে ফ্যাসিবাদ তাদের মৌলিক মূল্যবোধ এবং জীবনযাত্রার প্রতিও হুমকি সৃষ্টি করে। এই বিস্তৃত জোট ফ্যাসিবাদকে একটি "সর্বজনীন হুমকি" হিসেবে তুলে ধরে।
ইতালিতে ১৯২২ সালে এবং জার্মানিতে ১৯৩৩ সালে ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রীয় মতাদর্শে পরিণত হওয়ার পর ফ্যাসিবাদ-বিরোধী কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যার মধ্যে জার্মানিতে নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ইতালীয় প্রতিরোধ আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার একটি প্রধান দিক ছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, পশ্চিমা দেশগুলো ফ্যাসিবাদের হুমকিকে ততটা গুরুত্ব সহকারে নেয়নি, এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা কখনও কখনও সাম্যবাদের সাথে যুক্ত ছিল। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাব পশ্চিমা ধারণাগুলোকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করে, এবং ফ্যাসিবাদকে কেবল সাম্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, উদার-গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যও একটি অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি সাধারণত ফ্যাসিবাদী ছিল, এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
আধুনিক বিশ্বে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদ বিশ্বমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেও, তার প্রেতাত্মা আজও ঘুরে বেড়ায়। মিত্রশক্তির বিজয়ের ফলে ইউরোপের অনেক ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটলেও , বেশ কয়েকটি আন্দোলন এবং সরকার ছিল যা আদর্শগতভাবে ফ্যাসিবাদের সাথে সম্পর্কিত ছিল। 'নিও-ফ্যাসিবাদ' শব্দটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উদ্ভূত ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলিকে বোঝায়। এটি প্রমাণ করে যে ফ্যাসিবাদ একটি স্থিতিশীল মতাদর্শ নয়, বরং এটি একটি "রূপান্তরিত ভাইরাস" যা তার সবচেয়ে বিতর্কিত প্রতীকগুলো ত্যাগ করে, কিন্তু অতি-জাতীয়তাবাদ, নেতা-পূজা এবং "আমরা বনাম তারা" আখ্যানের মতো মূল উপাদানগুলো ধরে রাখে। এর আধুনিক প্রকাশগুলো তাই সহজে চেনা কঠিন।
আধুনিক বিশ্বে, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীতে, এই সংগ্রাম চলছে, বিশেষ করে যখন ডানপন্থী জনতাবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের আধুনিক 'অ্যান্টিফা' রাজনীতি ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে শ্বেতাঙ্গ ক্ষমতাশালী স্কিনহেডদের দ্বারা আমেরিকান ও ব্রিটিশ পাঙ্ক দৃশ্যে অনুপ্রবেশের বিরোধিতার সাথে যুক্ত। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিক থেকে, পশ্চিম জার্মানিতে স্কোয়াটার দৃশ্য এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন জার্মানিতে অ্যান্টিফার উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর জার্মানিতে নিও-নাৎসিবাদের বৃদ্ধির পর অ্যান্টিফ্যাসিবাদ আরও বৃদ্ধি পায় । একবিংশ শতাব্দীতে, বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর, 'র্যাডিক্যাল রাইট' এর পুনরুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় এই আন্দোলন (অ্যান্টিফ্যাসিবাদ) ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে।
ফ্রাঙ্কোর স্পেন, পেরনের আর্জেন্টিনা, বা গ্রিসের গোল্ডেন ডন – এরা যেন সেই বীজেরই নতুন অঙ্কুর। রাশিয়ার পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প এবং বাংলাদেশের ইউনূসকে ঘিরে ফ্যাসিবাদ নিয়ে চলমান বিতর্কগুলো এই প্রাসঙ্গিকতার উদাহরণ। এই বিতর্কগুলো বোঝায় যে ফ্যাসিবাদ তার বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন করে, কিন্তু তার মূল "পৌরাণিক মূল" অক্ষুণ্ণ থাকে। এটি বোঝায় যে ফ্যাসিবাদ একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় মাত্র নয়, এটি একটি "পুনরাবৃত্তিমূলক হুমকি" যা নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
উপসংহার: ফ্যাসিবাদ কি আজও প্রাসঙ্গিক?
ফ্যাসিবাদ: ইতিহাসের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের সতর্কতা
ফ্যাসিবাদ কি তবে ইতিহাসের পাতায় শুধু এক দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়ে গেল? নাকি তার ছায়া আজও আমাদের চারপাশে ঘুরছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর আনুষ্ঠানিক পতন হলেও, এর বীজ যেন আজও সুপ্ত আছে । ফ্রানসিসকো ফ্রাঙ্কোর স্পেনের ফ্যালানজিস্ট এক-দলীয় রাষ্ট্র, হুয়ান পেরনের আর্জেন্টিনা, গ্রিসের গোল্ডেন ডন, এবং পুতিন, ট্রাম্প ও ইউনূসকে ঘিরে ফ্যাসিবাদ নিয়ে চলমান বিতর্ক এই প্রাসঙ্গিকতার উদাহরণ।
জর্জ অরওয়েল ১৯৪৪ সালে উল্লেখ করেন যে 'ফ্যাসিবাদ' শব্দটি প্রায় অর্থহীন হয়ে গেছে, যা কেবল "অবাঞ্ছিত কিছু" বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই তথ্যটি শুধু একটি ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ নয়, এটি একটি "সমসাময়িক সমস্যা" কে নির্দেশ করে। যদি "ফ্যাসিবাদী" শব্দটি তার নির্দিষ্ট অর্থ হারিয়ে ফেলে এবং কেবল একটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে প্রকৃত ফ্যাসিবাদী প্রবণতা যখন সমাজে দেখা দেয়, তখন তাকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ তখন এই অভিযোগকে নিছক রাজনৈতিক আক্রমণ হিসেবে উড়িয়ে দেয়। এটি ফ্যাসিবাদকে তার "ছদ্মবেশ" বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা তাকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে।
ইতিহাস এক নীরব শিক্ষক। সে বারবার একই ভুল না করার জন্য সতর্ক করে যায়। ফ্যাসিবাদ কেবল অতীতের এক কালো অধ্যায় নয়; এটি মানব ইতিহাসের এক পুনরাবৃত্তিমূলক প্রবণতা। যখন কোনো নেতা জাতির অপমান বা শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে, যখন ভিন্নমতকে দমন করা হয়, যখন অর্থনৈতিক সংকট বা সামাজিক অস্থিরতা মানুষের মনে হতাশা তৈরি করে, তখন ফ্যাসিবাদের সেই কালো ছায়া আবার উঁকি দেয়। এর মূল উপাদানগুলো, যেমন অতি-জাতীয়তাবাদ, নেতার উপাসনা, এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, আজও বিভিন্ন রূপে সমাজে বিদ্যমান। তাই, ফ্যাসিবাদকে কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে না দেখে, এর অন্তর্নিহিত বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং এর পুনরুত্থানের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।